তিন ছেলের পর মেয়ে জন্মানোয় বাবা মা বড্ড খুশি হয়েছিল। আদর করে নাম রেখেছিল অঞ্জলি। বাবা মা, ভাইদের কাছে একমাত্র আদরের ছোট বোন অঞ্জলি যাইই দাবী করতো তাই পেয়ে যেত। বলেতে গেলে সবাই মেয়েটিকে রাজকন্যার আদরে বড় করতে লাগলো । সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। একটু বড় হতেই, মানে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকে মেয়ের বিয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে থাকলো। অঞ্জলির কথা ছিল আগে পড়ালেখা শেষ করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এরপর ভেবে দেখবে। এরমধ্যে অনেক ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাবই মেয়েটির পরিবার ফিরিয়ে দিয়েছিল। পড়ালেখা শেষের পরপরই বাসা থেকে চাপ আসতে থাকলো বিয়ের। মেয়েটি সরাসরি জানিয়ে দিলো যে, সে বিয়ে প্রথায় বিশ্বাসী না। বিয়ে করা তার পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব না। যদি কারো সাথে থাকতে হয় তবে এমনিতেই বসবাস করতে পারে, এর জন্য বিয়ের মত চুক্তির দরকার হয় না। এর পেছনে তার যুক্তি ছিল, মতের অমিল হলে সম্পর্ক ভাঙ্গবেই, সেটা বিয়ে করলেও যা হবে- না করলেও তা হবে। বিয়ে ছাড়াও একসাথে বসবাস করা যায়। বিয়ে নামক চুক্তি দ্বারা ভালবাসা জিইয়ে রাখা যায় না। অঞ্জলির আরেকটি দাবী ছিল, বিয়ে করে তাকে তার বাড়ি ত্যাগ করতে হবে, এটা সে করতে পারবে না।
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে তার বাবা মা আর তার ভাইদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কিন্তু অঞ্জলি তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল স্পষ্ট। দিন যেতে থাকে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেও তার কোন চাকরি মিলছিল না। ইতিমধ্যে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় অঞ্জলীর এমন নীতিবিরুদ্ধ, প্রথাবিরুদ্ধ মতের কথা। রাস্তা ঘাটে আগে যেইসব ছেলে সমীহ করতো, তারাও ইয়ার্কি মারা শুরু করলো, এমনকি ছোট ছেলেরাও। ঘরে গ্রহণযোগ্যতা কমতে কমতে একেবারে অবাঞ্ছিতের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। একই বাবা মায়ের সন্তান হলেও তার বড় ভাই তখনো বিয়ে না করেও তার অবস্থানের এক চুল হেরফের হল না, অঞ্জলির অবস্থানের হল। দিনের পর দিনে পরিবারের সকল সদস্যের সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। তার কোন প্রয়োজনেও বাবা ভাই মা তাকে সাড়া দেয়াটা ছিল গলগ্রহের মত, অঞ্জলির দ্বারা এদের সাথে নিঃশ্বাস নেয়াটাও কষ্টের হয়ে উঠলো। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগলো দু'চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই চলে যাবে। যাই যাই করে আর তার যাওয়াটা আর হওয়াটা হয়ে উঠে না।
অঞ্জলি দুটো ছাত্র বাড়িতে পড়িয়ে যে টাকা পায় তা দিয়ে সে প্রতিমাসে কিছু বই কিনে। তার সময় কাটতো বই পড়ে, মাঝে মাঝে নিজেও কিছু লিখেটিখে, সেটা একান্তই নিজের মত করে, নিজের জন্যই, নিজের চিন্তা দর্শন হাবিঝাবি। কেউ জানে না তার মনের ভেতর কেমন উথাল পাতাল ভাঙ্গন চলতে থাকে। রাতের ঘুম কমতে থাকে, সাথে কমতে থাকে দিনের স্বচ্ছতা। মধ্যরাতের ট্রেনের বাঁশীর শব্দটা তাকে বরাবরই মাতাল করতো। সে রাতে তার মনে হলো, সমাজে বিয়ে ছাড়া যেহেতু নারী জন্মের কোন মানে নাই, তারও এই জীবন বাঁচিয়ে রাখার আর কোন মানে নাই। ট্রেন আসার শব্দ শুনতে শুনতে ঘরে থেকে সজ্ঞানে বের হয়ে সোজা বাঁশীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
রেলের রাস্তায় পরদিন সকালে তার মরা, কাটা, চ্যাপ্টে যাওয়া দেহটা পাওয়া গেলো। অঞ্জলির আর বিয়ে করা হলো না। যদিও অঞ্জলি বিয়ে না করলে কোন ছেলের জীবন জলাঞ্জলি যেত না; তবুও সে মরে গেলো। অঞ্জলির বিয়ে হলো না ঠিকই কিন্তু একটা কিছু হলো, তা হলো-পরিবারের সদস্যরা মেয়ের পালনের ভার বহন করা থেকে চিরতরে মুক্তি পেলো।
(যথা সম্ভব আবেগ বর্জন করে লেখার চেস্টা।)
No comments:
Post a Comment