কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ উপলক্ষে অর্জুন গীতার উপদেশাবলি প্রাপ্ত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন দুই পক্ষ রণক্ষেত্রে সুসজ্জিত, তখন অর্জুন দেখতে পায় উভয় দিকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে তার পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, সখা প্রভৃতি সমস্ত আত্মীয়স্বজন। এই যুদ্ধ সংঘটিত হলে তার বংশ বিনাশ ছাড়া আর অন্য কিছু হবে না। তখন অর্জুন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কে বলে, 'বংশের কাউকে হত্যা করলে শাস্ত্র মতে কুলক্ষয় দোষ হয়। কুল ক্ষয় দোষে দোষী হলে কুল ধর্ম নষ্ট হয়, কুল ধর্ম নষ্ট করলে কুলের স্ত্রী গণ ব্যভিচারিণী হয়, কুলের স্ত্রীগণ ব্যভিচারিণী হলে বর্ণ সংকর হয়। কোন ব্যক্তি এই দোষে দোষী হইলে সে কুল নাশকারী হিসেবে সে সহ তার সমস্ত পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয়। আমি এই মহাপাপের অনুষ্ঠান করতে পারব না। এই গুরুতর অপরাধ করা থেকে ধৃতরাষ্ট্র যদি আমাকে মেরেও ফেলে তাও আমার জন্য কল্যাণকর। আমি প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাব। আমার এই রাজ্যের দরকার নেই। আমি এই যুদ্ধ করতে পারবো না।'
নির্দয় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ তখন তাকে অর্জুন কে বলে, 'তোমার বুদ্ধি কম, শাস্ত্রের কথা বোঝার মত তোমার মেধা পরিপক্ব হয়নি। পণ্ডিত ব্যক্তি কি জীবিত কি মৃত কোন ব্যক্তির জন্যই পরিতাপ করে না। আর জীবের আত্মাই হল সব। আত্মা আগুনে পুড়ে না, জলে ভেজে না। আত্মা অবিনশ্বর। এর ক্ষয় নাই বিনাশ নাই। যে মনে করে জীবাত্মাকে বিনাশ করা যায় তিনি অনভিজ্ঞ। জীবিত ব্যক্তির মৃত আর মৃত ব্যক্তির জন্ম অপরিহার্য। অতএব তুমি শোক করা বাদ দিয়ে অত্যন্ত আনন্দ সহকারে জ্ঞাতিবর্গকে সমূলে হত্যা কর। এতে কেবল শরীর নষ্ট হবে আত্মার কিছু হবে না।'
শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে আরও বলে,'তুমি এমন মহারথী হয়ে যদি যুদ্ধ না করো তবে তুমি অন্য সকলের দ্বারা তিরস্কৃত হবে। তোমার মত ব্যক্তির তিরস্কৃত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। তাছাড়া তুমি যুদ্ধে জিতলে তুমি পৃথিবী উপভোগ করবে আর হারলেও তোমার জন্য স্বর্গ নিশ্চিত। দুই দিকেই তোমার লাভ। অতএব এই যুদ্ধ তুমি কর। করলেই তোমার জন্য লাভ আর লাভ। জয় পরাজয়ের কথা না ভেবে একাগ্র চিত্তে কাজ করে যাওয়াই কর্তব্য''। 'পুরুষ কর্মানুষ্ঠান না করলে জ্ঞান প্রাপ্ত হয় না এবং জ্ঞান প্রাপ্ত না হলে কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। '
কৃষ্ণ আরও বলে, ''প্রথমে বিষয়চিন্তা, চিন্তা হতে আসক্তি, আসক্তি হতে অভিলাষ, অভিলাষ হতে ক্রোধ, ক্রোধ হতে মোহ, মোহ হতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ উপস্থিত হয়। 'পুরুষ আসক্তি পরিত্যাগ করে কর্মানুষ্ঠান করলে মোক্ষ লাভ করেন।' তুমি লোকদিগের ধর্মরক্ষণার্থ কর্মানুষ্ঠান কর।'
যদিও এখানে বিষয় চিন্তা মোহ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে তবুও শ্রী কৃষ্ণ নিজেই অন্য জায়গায় অর্জুন কে স্বর্গের লোভ এবং রাজ্যের লোভ দেখিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন। গীতার এক জায়গায় বলা হয়েছে লোভ ত্যাগের কথা আরেকবার দেখানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের লোভ। এটা নিঃসন্দেহে শ্রী কৃষ্ণের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। অপরদিকে যদি ধর্মরক্ষার্থেই যুদ্ধ করার কথা কৃষ্ণ বলে থাকে, তবে কুল ধর্ম বিনষ্ট করলে ধর্ম নষ্ট হবে সেটা আগেই বলা হয়েছে। এরপর ও যদি যুদ্ধ করতে হয় তবে অর্জুন স্বর্গপ্রাপ্ত হতে পারে না। কারণ কেউ কুল বিনষ্ট ধর্ম নষ্ট হয়, আর ধর্ম নষ্ট হলে কিভাবে পুর্বপুরুষ সহ নরক প্রাপ্ত হয় তা উপরে বলা হয়েছে।
এইসকল যুক্তি দেখে পড়ে বুঝে হিন্দু উপাসকেরা নিষ্ঠুর নির্দয় শ্রী কৃষ্ণের মত ভগবান কে উদার, দয়াবান, শ্রেষ্ঠ জানতে বা মানতে বা বলতে তারা পিছপা হয় না। এইসব উপদেশ শ্রবণ করে সম্পত্তির জন্য হিন্দু উপাসকেরা পিতৃকূল হত্যা, বংশ নির্মূল করার মত গর্হিত কাজের মধ্যেও মহত্বতা খুঁজে পান। ধর্ম যুদ্ধ বা ধর্ম রক্ষার্থে বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ করার কথা বলা হলেও, মূলত এই যুদ্ধটা ছিল অর্থ রক্ষা রাজ্য রক্ষা আর বিষয়াদি রক্ষার যুদ্ধ।
No comments:
Post a Comment