নব্বই এর দশকে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে তোলপাড়, লক্ষ্য লক্ষ্য লোকের মিছিল মিটিং, অবরোধ, ফতোয়া জারী, মাথার মূল্য নির্ধারণ, পত্রিকায় দিনের পর দিন হাজারো লেখালেখি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আলোচনা সমালোচনা, হাইডিং, দেশত্যাগ এগুলা তসলিমা নাসরিনের আগে কার জন্য এমন তুমুল ভাবে হয়েছিল বাংলায়? তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ কি ছিল? নারীবাদ চর্চা নাকি নাস্তিক্যবাদের নামে ইসলাম ধর্ম বিরোধী কথা বলার কারণে? ঠিক কোন কারণে সে দেশে থাকতে পারেনি, কোন কারণে তাকে বাঁচার জন্য লুকিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল? তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগে আদালতে মামলা উঠেছিল, গ্রেফতারি পরোয়ানা হয়েছিল? সেগুলো আমরা কেউ কি জানি নাকি জানি না? অথবা জানলেও না জানার ভান করে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাই?
কেউ সহজে মুক্তচিন্তার আন্দোলনের কাজে তসলিমা নাসরিনের নামটা বা অবদানের কথাটা মুখে নিতে চায় না। নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা কি মুক্তচিন্তার মধ্যে পরে না? নাস্তিকতাবাদ কি নারী মুক্তির বাইরের কিছু? হুমায়ুন আজাদ নারী নামক গ্রন্থ, যে বইটির বেশিরভাগ অংশই বিশ্বের অন্যান্য নারীবাদী লেখক, দার্শনিক এবং কবি, সাহিত্যিকদের নারী বিষয়ক আলোচনা সমালোচনামূলক সঙ্কলন বলা যেতে পারে। এছাড়া আরজ আলী আর আহমদ শরীফ নারী মুক্তির জন্য কি বলেছেন? কোথায় বলেছেন? নারী মুক্তি ছাড়া নাস্তিকতার চর্চা আদৌ কি কি সুফল বয়ে আনতে পারে? যদি আনতে পারে সেগুলো কি কি? যদি না আনতে পারে তবে এসব ক্ষেত্রে নারীবাদীদের অবদান স্বীকৃতি পায় না কেন?
তসলিমা নাসরিনের বাংলাদেশে থাকার সময়ে তাঁর চেয়ে হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ আর আরজ আলী মাতুব্বর কতোটা জনপ্রিয় ছিল? প্রথম কোন লেখকের লেখা হটাত উঠা ঘূর্ণিঝড়ের মত আন্দোলিত করে ভাঙ্গন ধরিয়েছিল ধর্মান্ধ কুসংরাচ্ছন্ন নারীবিরোধী বাঙ্গালি সমাজে ? বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার আন্দোলনে তসলিমা নাসরিনের অবদান কতটুকু? প্রান্তিক পর্যায়ে এসব বিষয়ে প্রথম কার নাম লোকের মুখে উঠে?
আজ ব্লগারদের মুক্তবুদ্ধির চর্চার কারণে মরতে হচ্ছে, দেশ ছাড়তে হচ্ছে। তাদেরও দেশে ঢোকার পারমিশন আছে। তসলিমা নাসরিনের নেই কেন? তসলিমা নারসিন দেশকে টেনে নিয়ে কোন চুলোতে ঢুকিয়েছেন? এতে কার কোন অঙ্গ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে? ঠিক কোন কারণে তাকে একটা গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? আমরা যারা নাস্তিক্যবাদ প্রচার করি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি সমস্তই ধার্মিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নোংরা রাজনীতির দিকেই আঙ্গুল তোলে। ব্লগার বলেন কবি বলেন আর সাহিত্যিক যারাই এসব বিষয়ের বিরুদ্ধে লেখেন তাদের বেশিরভাগ অংশটাই পুরুষ। তারা নাস্তিক্যবাদ পছন্দ করেন কিন্তু পুরুষ-তন্ত্র বা ডিরেকটলি পুরুষের বিরুদ্ধে কথা বলাটা তারা খুব একটা পছন্দ করেন না; তাদের সংজ্ঞায় ঠিক শালীনতার পর্যায়ে পরে না। একজন নারী হয়ে পুরুষের প্রকাশ্য বা লুকায়িত সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে এভাবে লেখালেখিটা তাদের চোখে ধৃষ্টতা হিসেবই গণ্য। যে কারণে কোন ব্লগার, কবি, সাহিত্যিক, লেখক বাংলাদেশের প্রথাবিরোধী কোন লেখার কথা-লেখকের কথা বলার সময় কেউই তসলিমা নাসরিনের নামটা মুখে নিতে চান না। সরকার, ধর্মান্ধ মৌলবাদী, পুরুষতান্ত্রিক সুশীল লেখক ব্লগার সবাই চায় তাঁর নামটা-তার ইতিহাসটা দেশ থেকে মুছে যাক। পারলে তারা দু কলম তাঁর বিরুদ্ধে লেখবে যাতে লোকে তাঁর সম্পর্কে ভুল তথ্য লালন করে, কিন্তু তাঁর অবদান, তাঁর স্বীকৃতি বা তাঁর পক্ষে কথা বলার জন্য তাদের কলমে কালি থাকে না, মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হয় না।
তসলিমা নাসরিন ইস্যুতে তারা নিজেরাই একেকজন সর্বেসর্বা। পারলে তারা মুক্তচিন্তা, নারীবাদ ও নাস্তিক্যবাদ প্রসারে পুরুষ লেখকদের অবদানের কথা জোরাল কণ্ঠে বলে দিবে। তসলিমা নাসরিন এসব বিষয়ে কিছু বলেননি, কিছু করেননি তাই তাঁর নাম বলা নিষিদ্ধ, তাকে নিয়ে দেশের কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি, যে কারণে পুরষ প্রথাবিরোধী লেখকের বই বাজারে প্রকাশের অনুমতি পেলেও, তসলিমা মত নারী লেখকের বই প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী বহাল থাকে। তাঁর নাম নেওয়া যেমন নিষেধ তাঁর বই প্রকাশ করা এবং বিক্রি করাও নিষেধ, তাঁর বই পড়া নিষেধ। অতএব তাঁর অবদান নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পরবে না?
বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক লেখকেরা চায় তসলিমা নাসরিনের নামটা বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের মত এক অজানা গহ্বরে বিলীন করে দিতে, যাতে করে বাংলার নাস্তিক্যবাদ বা নারী জাগরণসহ সমস্ত ক্ষেত্রে পুরুষ লেখকদের অবদানটা নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করে, আর নারী লেখক তসলিমা নাসরিনের নামটা ধামাচাপা পরে অন্ধকারে অতলে অজানায় হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এটা যত বেশি ঘটতে পারে ততোই তাদের জন্য মঙ্গল।