আমার মেয়েবেলাতে একটা ছোট্ট অংশে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিয়েছিলেন তসলিমা নাসরিন। যেই মেয়েকে ভাত খাওয়ানোর জন্য বাঘ সিংহের গল্প ফাঁদতে হতো, সেই মেয়ে খাওয়া শেষে আঙ্গুল চেটে বলে,'মা আরেকটু ভাত দেও।' বাসার দুইটা মেয়েই খায় ভাত আর সবাই সবাই দুই বেলা রুটি। তনার মা ভাতের ফেন জমিয়ে রেখে হাড় কোঠরে ঢুকে যাওয়া বুভুক্ষু মানুষদের দিতেন। বাড়ির সামনে দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির মিছিল যায়, 'ভাত চাই, অন্ন চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই।' মায়ের মানা উপেক্ষা করে কিশোরী বয়সে ইট দিয়ে চালের ড্রামের তালা ভেঙ্গেছিল তনা, তার বাঘের চেয়ে ভয়ঙ্কর বাবার দেওয়া তালা,শক্ত তালা। গামছা ভরে তলানির চাল দিয়ে ভেবেছিল, আমিও যদি এদের সাথে ক্ষুধার্তদের জন্য অন্ন সংগ্রহ করতে পারতাম!
বিদেশ বসে দেশের খবর পড়ি, ধর্ষণের খবর, পাবনায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, কিশোরগঞ্জে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ধর্ষণ, চট্টগ্রামে চার ছেলেকে ধর্ষণ, নান্দাইলে বাসের ভেতর কিশোরী ধর্ষণ...দেশে চলছে একের পর এক ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা উৎসব। এসব ধর্ষণের সংবাদের সাথে নিজে ঠিক একাত্ম হতে পারি না, আমার পোষ্টে আমাকে যারা প্রকাশ্যে ধর্ষণ করে তাদের মত নিজেকে আনন্দিত করতে পারি না। ঘুমের ঘোরে ধর্ষণের শিকার মেয়েরা কথা কয়। গলা শুকিয়ে আসতে থাকে... বাসা থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে থাকি। আশে পাশের চকচকে শহর ক্ষণেই ধুয়া-শা আর ঝাপসা হয়ে উঠে। নিজেকে লুকানোর জায়গা খুঁজতে থাকি। ঘরে বাইরে কোথাও মুখ লুকানোর মত নির্জনতা নাই। এতো এতো সভ্য মানুষের মধ্যে নিজেকে বেশ অসভ্য মনে হতে থাকে, নিজেকে জংলী মনে হতে থাকে। যেন এক পাল ধর্ষক আমকে বিবস্ত্র করে ছিঁড়ে বিড়ে খাচ্ছে। আমি ধর্ষিতা আর আমার সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। আমি চিৎকার করছি, আমার চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না, শুনবে কিভাবে ? আমার কান্না শোনার কোন পথ নেই, ওরা আমার মুখ চেপে ধরেছে, একটু পর মেরেও ফেলবে।
এই অবস্থায় দেশের কিছু মানুষ নারী ধর্ষণের বিচার চায়। নিয়ম করে নাস্তিক হত্যা হয়, মরার আগ মুহূর্তেও বিচার চাওয়ার জন্য যেই মনটা ছুটে চলে অসভ্য দেশে, সেই মনটা হটাতই মুখ ফিরিয়ে নেয়। বমি আসতে থাকে, বিদেশে বসে দেশের উপর, দেশের প্রশাসনের উপর ঘৃণায় লজ্জায় আর হতাশায় আমার অন্তর আত্মা পানিশূন্য হয়ে উঠে।
দেশ দুর্ভিক্ষ চলছে! দেশের ছেলেরা- দেশের ধার্মিকেরা আজ ক্ষুধার্ত, ওদের রক্তের নেশা, ওদের মাংসের নেশা, আরও রক্ত চায়, আরও মাংস চায়। 'রক্ত চাই, মাংস চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই'--এ যেন ওদের শ্লোগান! নষ্ট বুদ্ধিজীবীরা জিম্মি, সাধারণেরা ধার্মিকেরা খুশি, নারীরা ধর্ষিত, যারা কথা বলবে তাদেরকে একে একে ধরে ধরে মেরে ফেলা হবে। এই ক্রান্তিকালে শুধু সেই কম্যুনিস্ট পার্টির স্কুল বালক গুলা নেই, আর নেই তসলিমা নাসরিনের মত মানুষ। যারা শত বাঁধা উপেক্ষা করেও শক্ত তালা ভাঙ্গবে। এরা সবাই ধার্মিক হয়ে শান্তির পথে চলে গেছে।
No comments:
Post a Comment