আপনি আপনার দেশ, পরিবার, বন্ধু-আত্মীয়, পরিচিত পরিবেশ, আপনার বিছানা, সকাল সন্ধ্যা, দেশ ছেড়ে বিদেশে এলেন। এমন এক দেশে এলেন, যেখানের কোন গাছের নাম আপনি জানেন না, কোন মাছের নাম না, কবুতর ছাড়া কোন পাখির নাম না, দুই একজন স্বদেশী ছাড়া কোন মানুষকেও আপনি চিনেন না। ওরা আপনার মত পোশাক পড়ে না, আপনার খাবার খায় না, আর আপনার আর তার ধর্মের অবস্থান দুই মেরুতে। ১৫/২০ দিনে সূর্যের মুখ দেখা যায় না,তাপমাত্রাও হিমাংকের নিচে, মাঝে মাঝে বরফে ছেয়ে সাদা হয়ে যায় চারপাশ। আপনি কি এই অসহায় অবস্থায় মরে যাবেন না তারা আপনাকে মেরে ফেলবে, এটা আপনি বা তারা কেউই করবেন বলে মনে হয় না।
তেমনি প্রতিটা মানুষের চিন্তা-চেতনা, দর্শন, মতাদর্শ, গড়ে উঠে সমাজ পরিবেশ সর্বোপরি সে কি শিক্ষা গ্রহণ করেছে তার উপর। আপনার মনে জিজ্ঞাসা এলে, প্রশ্ন এলে আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, যুক্তিসংগত উত্তর খুঁজবেন। কোন কিছু মানব জাতির মসৃণ চলার পথে বাঁধা মনে হলে, অযৌক্তিক কিম্বা ক্ষতিকর মনে হলে, এমন কোন নিয়মাদি বা সিস্টেম পেলে আপনি প্রতিবাদ করবেন। আপনি চাইলে সুশীল হতে পারেন। সব কিছু জানিয়া বুঝিয়া না খেপিয়া বিষবৃক্ষের গোঁড়ায় জলদান করিতে পারেন। সবাই তা পারে না। কেউ কেউ একটু নড়েচড়ে উঠে, কেউ আবার এইসব কুপ্রথা আর তার দ্বারা কৃত অন্যায় ও অনিষ্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, আওয়াজ করে, কলম তোলে, এখন অবশ্য কীবোর্ড চাপায়। মানব সভ্যতা এইভাবেই এগিয়েছে, এইভাবেই এগোয়।
বাহ্যিক এবং অন্তর্নিহিত সম্পূর্ণ অমিল থাকা সত্যেও ওই বিরুদ্ধ দেশে বিপরীত পরিবেশে আপনাকে কেউ গির্জায় যেতে বাধ্য করেনি। আপনি সেখানে অনেক নিরীশ্বরবাদী দেখেছেন প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরে বাড়াতে। আপনি আপনার মত চলতে পেরেছেন দিব্বি। কিন্তু আপনার দেশের কোন ব্যক্তি আপনার ধর্মের প্রচলিত ন্যায় বিরোধী কর্মকাণ্ড অথবা অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক হাস্য কর কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বললে, আপনি তাকে হত্যা করবেন বা আপনার ভয়ে তাকে পালিয়ে দেশত্যাগ করতে হবে বা আপনি তাকে নির্বাসিত করবেন, এটা কেমন শিক্ষা? আপনার মানসিকতায় মানব হত্যার মত সংস্কৃতি যাতে বাসা না বাঁধে এর জন্য যেই লোকটি কথা বলতেন, তাকেই আপনি হত্যা করলেন?
আপনি সেই দেশে তাদের মত শুকর খান না বলে, তাদের ধর্ম না মেনে শুকরের বাচ্চা বলে কটাক্ষ করেন বলে, বা পাঁচ-বেলা আপনার মত ফ্লোরে মাথা ঠুকে না বলে অথবা মালাউন কাফের মুরতাদ বলে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকান বলে তারা কিন্তু আপনাকে মারতে আসেনি। অথচ আপনি মারতে আসেন, আপনি আক্রোশে রাগে হিংসায় ঘৃণায় আক্রমণ করতে আসেন আপনার পরিচিত অঙ্গনের নাস্তিক, হিন্দু, উপজাতি সহ আরও বিধর্মীদের।
আপনি ভুলে যান আপনার এই একমাত্র পরিচিত আল্লা ছাড়া আরও ঈশ্বর আছে পৃথিবীতে, আরও অঞ্চল আছে যেখানেও এই ধর্ম ছাড়া লোকে সুখে শান্তিতে বসবাস করে, আরও ফুল পক্ষী লতা পাতা বরফ হিম হাওয়া আছে যা আপনার অচেনা। ওখানেও মানুষ বাঁচে, মানুষ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদেরও ঈশ্বর আছে আপনারই মত। ওখানেও নাস্তিক আছে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে অস্বীকার করে। তারা আপনি ভিন্নবর্ণ ভিন্নভাষী ভিন্নধর্মী বলে আপনাকে কোপাতে আসবে না। আপনি যাবেন, আপনি যান। কারণ আপনার জগত এটুকু জানা শোনার বোঝার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এর বেশী কেউ বললে, বুঝলে, ব্যাখ্যা করলে আপনার কাছে সীমালঙ্ঘন মনে হয়, আর সীমা-লঙ্ঘনকারীকে হত্যার নির্দেশ রয়েছে আপনারই পরম পূজনীয় গ্রন্থে। মানুষ দেখতে দেখতে খায় (পড়ে), খাইতে খাইতে (পড়তে পড়তে) শিখে, শিখতে শিখতে সভ্য হয়। আপনি দেখবেন অন্ধকার, খাবেন নোংরা, আপনি শিখবেন অসভ্যতা আর আপনার আচরণও হবে কালো বর্বর এবং কুৎসিত, এটাই স্বাভাবিক।
No comments:
Post a Comment