Friday, April 22, 2016

এরিস্টটলের সময়ে তিনি ছিলেন মহানবীর মত সম্মানীয়। এরিস্টটলের (৩৮৪-৩২২ খ্রীঃ পুঃ) পূর্বে প্লেটোও তার ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিলেন পৃথিবী স্থির। সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য সকল নক্ষত্ররাজি পৃথিবীকে ঘিরে পদক্ষীন করে। কোপার্নিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) আগে পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থও ভূ-কেন্দ্রিক এই মডেলটি বিশ্বাস করতো। কোপার্নিকাসের আগে ভূ-কেন্দ্রিক এই মডেলের বিরোধিতা করেছিলেন এরিস্টাকাস্ট (৩১০-২৩০ খ্রী পূঃ) । তিনি অতি সাহসের সাথে এরিস্টটলের মতবাদ কে অস্বীকার করে বলেছিলেন পৃথিবী এক বছরে সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসে, যাকে আমরা এখন বার্ষিক গতি বলে জানি। এমনকি তিনি এক দিনে পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর আবর্তন করে (আহ্নিক গতির কথা) সেটাও বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তার মতবাদের পক্ষে সেসময় কোন গাণিতিক প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। আর এরিস্টটলের প্রতিপত্তি ছিল বিশাল। তার অনুরাগীর সংখ্যা ছিল অনেক, বিধায় এরিস্টাকাসের 'সূর্যকেন্দ্রিক'(Heliocentric)মতবাদ খড়-কুটোর মত ভেসে হারিয়ে যায়। গ্রীক জোতির্বিদ টলেমীর ১৪০ খৃষ্টাব্দে দেওয়া 'সর্বকালের শ্রেষ্ঠ' ভূ-কেন্দ্রিক ভুল মডেলটি তের শত বছর ধরে রাজত্ব করে। যা পরে প্রথম বাঁধার সম্মুখীন হয় পোলিশ এক যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাসের মাধ্যমে। তিনি পৃথিবীকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে সূর্যকে কেন্দ্রে এনে একটি বই লিখে ফেলেন ১৫৩০ সালে। বইটি লেখার ১৩ বছর পর ছাপানো হলেও রোমান ক্যাথলিক চার্চ এই বইটিকে ৭৩ বছর নিষিদ্ধ করে রাখেন।
অতঃপর গ্যালেলিও (১৫৬৪-১৬৪২) টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে দেখলেন চাঁদের পাহার এবং বৃহস্পতির উপগ্রহ যারা বৃহস্পতির চারদিকে ঘুরে। তিনি আরও দেখেন শুক্র গ্রহও আমাদের চাঁদের মত একটি পূর্ণ চন্দ্র-কাল অতিক্রম করে। এ থেকে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র নয়। যা কিনা কোপার্নিকাসের মতবাদ সমর্থন করে। কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ সমর্থনের কারণে ১৬০০ সালে জিওদার্নো ব্রুনো কে রোমে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। মরার আগ মুহূর্তেও তাকে বলা হয় পৃথিবীকেন্দ্রিক মতবাদ কে স্বীকার করে নিতে, কিন্তু তিনি মরতে রাজি ছিলেন কিন্তু মিথ্যা গ্রহণ করেননি। গ্যালেলিও তার মতবাদ ১৬১০ সালে (The Starry massenger)বইয়ে প্রকাশ করেন। যা তার জন্য কাল হয়ে উঠে।
গ্যালেলিও খুব উৎসাহ ভরে তার মতবাদ চারদিকে প্রচার করেন। অবশেষে ১৬১৬ সালে তাকে 'ধর্মবিরোধী'(heretical) হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। অবশেষে ১৬৩২ সালে টলেমী আর কোপার্নিকাসের বিশ্বতত্ত্বের আলোচনা করে তার বিশ্ব বিখ্যাত ''Dialogue Concerning the Two Chief Systems of the World- Ptolemaic and Copernican'' বই লিখেন। বইটি ছিল মোটামুটি কথোপকথন ভিত্তিক। তিন জনের কথোপকথন একজন কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের সমর্থক, অন্যজন এরিস্টটেলীয় দার্শনিক টলেমীর পৃথিবীকেন্দ্রিক মতবাদের সমর্থক, অন্যজন নিরপেক্ষ। ইতালীয় সহজলভ্য ভাষায় বইটি রচনার কারণে সাধারণের কাছে বইটি বুঝতে সহজ হয় এবং কোপার্নিকাসের সমর্থক চরিত্রের তুখোড় যুক্তির কারণে এরিস্টটলীয় চরিত্রটি নাজেহাল হয়ে যায়।
১৬৩৩ সালে চার্চ পুনরায় গ্যালেলিও কে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। গ্যালেলিওর তখন বৃদ্ধ বয়স ,সূর্যের দিকে অবিরাম তাকিয়ে থাকার কারণে শেষ বয়সে গ্যালেলিও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এই অবস্থায় অসুস্থ বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে টেনে হেঁচড়ে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে লোকে সম্মুখে হাঁটু মুড়ে বসে সবার সামনে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয় এবং তাকে স্বীকার করতে হয় এতো দিন তিনি যা যা লিখেছেন ও প্রচার করেছেন তা সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী, ভুল এবং মিথ্যা। তিনি এও বললেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে এবং স্থির অনড়। জীবন বাঁচাতে তিনি মিথ্যে বলেছিলেন। শোনা যায় একবার তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে এও বলেছিলেন, ''তারপরও পৃথিবী কিন্তু ঠিকই ঘুরছে''। নিজ গৃহে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান ১৬৪২ সালে।
গ্যালেলিওর মৃত্যুর ৩৫০ বছর পর ১৯৯২ সালের ৩১ শে অক্টোবর পোপ জন পল-২ ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে একটি বক্তব্য দিয়ে স্বীকার করেন, চার্চের গ্যালেলিওর প্রতি তখনকার আচরণ সঠিক ছিল না।
তথ্যসংগ্রহঃ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী---অভিজিত রায়

No comments:

Post a Comment