“দিতে পার একশ' ফানুস এনে আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।” হুমায়ুন আহমেদ এই কবিতাটা যখন লিখেছিলেন তখনো তিনি ফানুস স্বচক্ষে দেখেননি।
আমার মনে আছে ক্লাস ফোরে থাকতে প্রথম আমি কবিতা লিখেছিলাম নদী নিয়ে। তখনো স্বচক্ষে নদী দেখিনি। এরপর স্কুলে পড়ার সময় প্রায়ই রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখতাম। তখনো জানতাম রবীন্দ্র সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ লিখতে পারে না। এর বহুকাল পর বন্ধুরা মিলে যখন একদিন সবার কিছু না কিছু লেখালেখি বাধ্যতামূলক ফর্দ ধরিয়ে দেওয়া হলও, সে রাতে অনেক কষ্ট করে একটা কবিতা লিখেছিলাম বর্ষাকাল নাকি বসন্তকাল নিয়ে! কিছু তো হয়ই-নি উল্টো আরও নিজের লেখার অপরিপক্বতা নিয়ে নিজেকেই লজ্জিত হতে হয়েছিল। সে কবিতা এখনো আছে আমার কাছে। পড়লে নিজেই অবাক হই। আমার বর্তমানের সব কবিতা মূলত গদ্যছন্দে, খুব কম সংখ্যকই ছন্দ মেনে লেখা। মাত্রা, ছন্দ মেপে আমি কবিতা লিখতে আমি পারি না। পারলেও পুরোভাব উঠে আসে না। আর আমার কবিতাগুলো কবিতার কাতারেও পরে না। কবিরা এগুলোকে কবিতা বলবেন না।
কোন বিষয়ে লিখতে গেলে সে বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখা জরুরী। যদি গদ্য হয় তবে তো আরও জরুরী। পদ্যে মূলত ভাবটা জরুরী। লালন শিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু তার কবিতার ভাব আমাদেরকে পরিপাটি শিক্ষিত করে। পদ্য লেখা যথেষ্ট কঠিন কাজ। কারণ পদ্যে চাইলে পুরো একটা জাতির ইতিহাসকে অল্প কথায় ফুটিয়ে তোলা যায়। ভাষার প্রাঞ্জলতা এবং পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখে অনেক বড় কোন বিষয়কে ছোট পরিসরে নিয়ে আসতে হয়। একটা বিতর্কিত ছোট্ট কবিতা কোন জাতিতে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। একটা কবিতা কোন জাতিতে প্রেরণা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সহায়কও হতে পারে।
জীবনানন্দ দাশকে তার প্রকাশিত ক্যাম্পে কবিতার জন্য অশ্লীলতার দায়ে চাকরীচ্যুত হতে হয়েছিল। 'কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়' এই নামে একটি কবিতা লেখার জন্য 'জন্মই আমার আজন্ম পাপ' কবিতা খ্যাত কবি দাওদ হায়দারকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনও যাত্রী ছিল না। তাঁর কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ। এখনো ফিরে পাননি তার নাগরিক অধিকার। এরকম আরও অনেক উদারহন আছে। তসলিমা নাসরিন মৌলবাদীদের রোষানলে পরে দুই মাস হাইডিঙ্গে থাকার পর দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজও তিনি ফিরে আসতে পারেননি তাঁর মাতৃভূমিতে। 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি'... ১৯৭১ সালে এমন অনেক কবিতা মুক্তিযুদ্ধের গান হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে, যা যোদ্ধাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কবিরা পারেন কোন দেশের অভিধানে নতুন নতুন শব্দ যোগ করতে। কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেসময় রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে ছাত্রদের কে ভুল বানান শুদ্ধি করণের পাঠ দেওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথ বিখ্যাত হওয়ার পর সে দায় ঘুচেছে।
কোন কবি বা লেখক জীবদ্দশায় বিখ্যাত হয়ে গেলে তিনি মারা গেলে তার সম্মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেলেন, তিনি জীবিত থাকতেই সেই সম্মান পেয়ে গেছেন। জীবনানন্দ দাশ পাননি। জীবনানন্দ দাশ মরে যাবার পর বিখ্যাত হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কবি বা শুদ্ধতম কবির সম্মান তিনি পেয়েছেন, তবে তিনি মারা যাওয়ার পর। বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে-কথাটা মিথ্যা নয়।
No comments:
Post a Comment