Wednesday, November 16, 2016

আমার বোনের মেয়ে পড়ে কলেজে, আর ছেলে ক্লাস ফাইভে। সারাদিন বাসা-বাহিরের কাজ, বাজার-রান্না,ছেলেকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া, ওর পড়া, খেলা ইত্যাদি নিয়েই তার সময় চলে যায়। সে আমাকে কয়েকদিন আগে বলছিলও, ''আরেকটা বাচ্চা নিতে হতো আমার, ভুল করেছি, ছেলেটা তো আর এক বছর পর একা একাই যাতায়াত করবে স্কুলে, নিজের পড়াও নিজেই করবে, তখন আমার সময় কিভাবে কাটবে?'' আমাদের সমাজের বাবা মায়েরা যারা সন্তান নেন, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সবই নিজেদের প্রয়োজনে। প্রথমত সন্তান উত্তরাধিকার, বংশলতিকা রক্ষা করবে, দ্বিতীয়ত মানুষ হিসেবে জন্মের একটা অবধারিত নিয়ম হলো সন্তান লালন পালন এবং ভরন পোষণ। মানুষকে কিছু না কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকে জীবন পার করতে হয়। অভিভাবকেরা সন্তান ধারণ পালন কে জীবনের কাজের অংশ হিসেবেই মেনে নেয়। এটা কিন্তু একজন মানুষ কে মানুষের মত মানুষের হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নয়, সেটা নিজেদের প্রয়োজনেই নিজের অপূর্ণ সাধ আহ্লাদ পূরণের জন্যই করে থাকে। এখানে পুরোপুরিভাবে ব্যক্তিগত আত্মতুষ্টি এবং স্বার্থ জড়িত।
নিজের জঠর ছিঁড়ে বের হয়ে আসে বলেই অথবা নিজের রক্তের টাকায় খাইয়ে পড়ে বাঁচে বলেই সেই সন্তানের প্রতি থাকে বাবা মায়ের সীমাহীন ভাল ভাল ভালোবাসা। একজনের সন্তান ফার্স্ট হতে হলে কাউকে না কাউকে সেকেন্ড হতে হবে। সব বাবা মা-ই চায় আমার সন্তান যেন সেকেন্ড না হয়। একজন পিতা বা মাতা নিজের সন্তানের যতোটা ভাল চায়, ঠিক ততোটুকুই অন্যের সন্তানের খারাপ চেয়ে থাকে। সাধ্যের উপরে নির্ভর করে স্বার্থের পাল্লা। কেউ হয়তো হাজার টাকার জামা কিনে দিতে পারে সন্তানকে, কেউ বা শত টাকার, আক্ষরিক ভাবে স্ট্যাটাস অনুযায়ী পোশাকের চাকচিক্যে ওজনে তারতম্য থাকলেও, সন্তানের জন্য স্বার্থের ভাবানুবাদ সকল বাবা মায়ের এক।
ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক একসময় নষ্ট হয়ে যায়, ভাইদের সন্তানদের উত্তরাধিকার রক্ষার খাতিরেই। মেয়েরা সন্তান জন্মদান লালনপালন করলেও, উত্তরাধিকারে সম্পত্তির সঠিক বণ্টনের নীতি না থাকায় এক্ষেত্রে স্বার্থটাও হিসেব করতে হয় ছেলে সন্তানের উপর নির্ভর করে। এখানে আরেকটা বিষয় বাদ পরে গেলো-সেটা হল ভালোবাসা। সন্তান ভালবাসার ফসল, বাবা মেয়ের সন্তানের প্রতি ভালবাসাও থাকে প্রবল। এটা এমন নয় যে, সন্তানের প্রয়োজনে তারা ভালবেসে জন্ম দেয়, এটা এমন-নিজেদের প্রয়োজনে সন্তান জন্ম দিয়ে তাদেরকে ভালবাসে। ভালবেসে সেই ভালবাসার প্রতিদানও তারা ধার দেওয়া টাকার মতো পদে পদে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু স্বার্থের কাছে সেই ভালবাসাটা হার মেনে যায়। যদি স্বার্থের কাছে ভালোবাসা হার মেনে না যেতো তবে একজন সুস্থ বাচ্চার চেয়ে একজন প্রতিবন্ধী বাচ্চা অবহেলিত থাকতো না। অথবা সম্পত্তি থেকে শুরু করে নারী পুরুষের বৈষম্য মূলক হাজারো নীতি তৈরি হতো না। একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে একই মায়ের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করার পরও মেয়েটি পরিবারের একজন গৌণ সদস্য হিসেবে ট্রিট হতো না। একই রকম মানব সত্ত্বা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেও, মেয়েদেরকে খড়কুটোর মত অস্তিত্বহীন ভাসমান জীবন যাপন করতে হতো না।
''আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'' ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যের একটি লাইন। সতেরশো সনের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই লাইনটি শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার কাছেই সমান ভাবেই সমাদৃত, ভালোই সমাদৃত। লাইনটা শুনতে ভাল শোনায়, কাজেও ভাল দেখায়। এরকম স্বার্থপর পিতা মাতা থাকলে সন্তানদের নিজেদের ভালমন্দ কাজের বা বিচারের আর কি চিন্তা, সমস্ত ঠিক করার জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে সেলফিশ প্রাণী বাবা মা তো আছেনই। শ্রদ্ধা, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, যাই বলা হোক না কেন; একটা ভাল সম্পর্কের ভিত্তি হলো স্বার্থ স্বার্থ এবং স্বার্থ।
একটু ভর্তির খবর নেওয়া যাক-
-ভাবী আমার ছেলে তো বুয়েট।
-ও আমার টা মেডিকেলে।
-শুনছি রুমানা ভাবীর মেয়ে নাকি কোথাও চান্স পায় নাই?
-পাবেই বা কীভাবে, ওই মেয়ের লেখাপড়ায় মন আছে? চরিত্রেরই তো ঠিক নাই। মাথায় শুধু ছেলে ছেলে আর ছেলে ঘুরে।
- আর ওই মেয়ে যে সুন্দরী, পোলাদের যন্ত্রনায় ওরে বেশিদিন ঘরেও রাখা যাবে না, এতো টাকা পয়সা খরচ করে পড়ায়েই বা কি লাভ? সেই তো পরের ঘরেই যেতে হবে।

No comments:

Post a Comment